ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৭/০৭/২০২৫ ৭:২৩ এএম

তিনদিন ধরে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে সবধরণের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নিম্নচাপ ও অমাবস্যার প্রভাবে প্রচণ্ড উত্তাল রয়েছে সাগর। পাশাপাশি জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৩ ফুট অধিক উচ্চতায় প্রবাহিত হওয়ায় দ্বীপের বিভিন্ন অংশের গাছপালা ভেঙে লোকালয়ে জোয়ারের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে শতাধিক ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়। এতে আতঙ্কে রয়েছেন দ্বীপের সাড়ে ১১ হাজার বাসিন্দা। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, অমাবস্যা জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৩ ফুট অধিক উচ্চতায় প্রবাহিত হয়ে দ্বীপের বিভিন্ন অংশের গাছপালা ভেঙে লোকালয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। এতে করে শতাধিক বসতঘর প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারে ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দ্বীপের চারিদিকে জিও ব্যাগ বা ব্লক ফেলানো না হলে মানচিত্র থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ হারিয়ে যাবে। গত বৃহস্পতিবার থেকে আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত টানা তিনদিন ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রলার চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। দ্বীপে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে শুরু হয়েছে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি। নিরাপত্তার স্বার্থে মাছ ধরার ট্রলারগুলো জেটির আশপাশে নোঙর করে রাখা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতি বছর দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের। লোকালয়ে সমুদ্রের জোয়ারের পানি ঢুকে ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনার চরম ক্ষতি হচ্ছে।

সাবেক ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে দ্বীপের মানুষ খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংকটে ভুগে আসছিল। এখন নৌযান বন্ধ থাকায় বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ফুরিয়ে এসেছে। আরও কয়েকদিন এভাবে থাকলে খাদ্যপণ্য এবং টেকনাফ থেকে কোনো খাদ্য পণ্য না পৌঁছালে খাদ্য সংকট দেখা দিবে প্রকট। এখানকার মানুষের কথা বিবেচনা করে জরুরি ভিত্তিতে সি ট্রাক ও সি অ্যাম্বুলেন্স চালু করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন তিনি।

টেকনাফ ট্রলারের টিকেট বিক্রেতা মোহাম্মদ ফারুক বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত এ নৌরুটে যাত্রীবাহী ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। সাগর উত্তাল হয়ে পড়ার কারণে মালিক সমিতি ট্রলার চলাচল বন্ধ করে দেন। আবহাওয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ট্রলার চলাচল শুরু করবে।

টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটের সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি রশিদ আহমদ জানান, দুর্ঘটনার আশঙ্কায় গত বৃহস্পতিবার থেকে তিনদিন ধরে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে মালামাল আনা-নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বীপবাসী কর্মহীন অবস্থায় আরও দুর্বিষহ সময় পার করছেন। আবহাওয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার নৌযান চালু হবে। সর্বশেষ গত বুধবার টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে নিত্যপণ্য ও যাত্রী নিয়ে তিনটি সার্ভিস ট্রলার সেন্টমার্টিন গেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছৈয়দ আলম বলেন, জোয়ারে দ্বীপের চারদিকে ভাঙন ধরেছে। বিভিন্ন অংশ দিয়ে জোয়ারের লবণাক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম জানান, তিনদিন ধরে নৌযান চলাচল বন্ধ। বাজারে খাদ্য পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সেন্টমার্টিন থেকে পারিবারিক কাজে টেকনাফ ও কক্সবাজার শহরে গিয়ে আটকা পড়েছেন দুইশতাধিক মানুষ।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার নৌযান চালু হবে।

টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপে ৭ নম্বর, ৮ নম্বর ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে একটি এলাকা। এই এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। চতুর্পাশে বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদী ঘেরা। তবে সাগর তীরবর্তী শাহপরীর দ্বীপের গোলাপাড়া, পশ্চিম পাড়া, দক্ষিণপাড়া, ডাঙর পাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, বাজারপাড়া ও জালিয়াপাড়া এলাকায় মানুষগুলো বেশি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। বাঁধ ভেঙে গেলে পুরো দ্বীপের মানুষ বসতি হারাবে।

সাগর তীরবর্তী এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তত্ত্বাবধানে ২০২২ সালের জুন মাসে ১৫১ কোটি টাকার খরচ করে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে প্রায় ৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের কিছু দিনের মধ্যেই বাঁধের সিসি ব্লকগুলো ধসে পড়ে।

শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা ও উন্নয়ন কমিটির সভাপতি প্রবীণ শিক্ষক জাহেদ হোসেন বলেন, ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের পশ্চিম পাশে ১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। সেই ১ কিলোমিটার ভাঙা বাঁধ নির্মাণে ১০ বছরে ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে পাউবো। দুর্নীতির কারণে বেড়িবাঁধ হয়ে ওঠেনি। ওই সময়ের জলোচ্ছ্বাসে শাহপরীর দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার একরের চিংড়ির ঘের ও ফসলি জমি সাগরগর্ভে তলিয়ে গেছে। বিলীন হয়েছে মসজিদ-মাদরাসাসহ অন্তত চার হাজার ঘরবাড়ি। প্রায় তিন বছর আগে ১৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধটির সিসিব্লক ধসে পড়ার ঘটনায় দ্বীপের লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজে তাড়াহুড়ো ছিল বলেও মন্তব্য করেন সাবরাং ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, প্রথম দিকে বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ টেকসই ছিল, কিন্তু দক্ষিণপাড়া অংশে যেখানে সাগরের আগ্রাসন বেশি, সেখানে এসে তাড়াহুড়া করে কাজ শেষ করায় বাঁধের কাঠামো দুর্বল হয়েছে। যে কারণে কিছু দিনের মাথায় ব্লকগুলো ধসে পড়ছে। আর এখন বর্ষা মৌসুমে বাঁধের উপর দিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ার পাশাপাশি বাধটি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পুরো এলাকার মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

টেকনাফ উপজেলা জ্যৈষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা ও সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, দ্বীপের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে শুক্রবার ও আজ শনিবার জোয়ারের পানি বেড়িবাধ টপকে লোকালয়ে প্রবেশ করায় এলাকার প্রায় চার হাজার পরিবারের ২০ হাজারের বেশি মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আজ রাতেও একই অবস্থা হলে বেড়িবাঁধটি বিলীন হয়ে যেতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড টেকনাফের উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, জোয়ারের পানি বেড়ে গিয়ে বাধ টপকে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

সাগর উত্তাল থাকার কারণে মিয়ানমার থেকে আসা ২০ রোহিঙ্গা ও একটি ট্রলার শনিবার ফিরে যেতে পারেনি। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে সাগর উত্তাল থাকায় ট্রলারটি সেন্টমার্টিনের উত্তর সৈকতের তীরে ভেড়ে। ট্রলারে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৬ জন পুরুষ, ৩ জন নারী ও একজন শিশু রয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন একটি পরিবারের সদস্যও রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। আবহাওয়া পরিস্থিতি ভালো হলে রোহিঙ্গাসহ ট্রলারটি মিয়ানমারের ফেরত পাঠানো হবে বলে বিজিবির দায়িত্বশীল একজন কর্মকতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা বর্তমানের বিজিবির হেফাজতে রয়েছেন।

পাঠকের মতামত

এনজিও সংস্থা সিএনআরএসের ১০ লাখ বাঁশের চারা বিতরণ প্রকল্পে অনিয়ম

কক্সবাজারে জলবায়ু পরিবর্তনে সহনশীলতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস) নামের একটি ...

কক্সবাজার হোটেল মিশুকে জার্মান পর্যটককে লাইনের পানি দিয়ে মিনারেল পানির বিল

কক্সবাজারের হোটেল মিশুকে এক জার্মান পর্যটককে লাইনের পানি দিয়ে মিনারেল পানির বিল ধরিয়ে হয়রানি করার ...